রহমত সালাম :
মহান আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন পবিত্র মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে ইরশাদ করেন –
“এই সেই রামাদান মাস যে মাসে নাজিল করা হয়েছে আল কুরআন। যা মানুষের জন্য হেদায়াত এবং সত্য পথের যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টিকারী বিধান। সুতরাং যে এ মাসের সাক্ষাৎ পাবে তাকে রোজা রাখতে হবে।” বাকারা-১৮৫।
বছরের বারোটি মাসের মধ্যে রামাদান সকল মাসের সেরা। এই কারণে যে, এ মাসে আল কুরআন নাজিল করা হয়েছে। আল কুরআনকে নাজিল করা হয়েছে মানুষকে সঠিক পথ দেখাবার এবং ন্যায়-অন্যায়ের প্রভেদ বুঝার জন্য।
মানুষ যদিও আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। প্রয়োজনীয় জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু জীবন চলার সামনে যদি পথনির্দেশনা না থাকে তবে ঐ থিওরিটিক্যাল জ্ঞান দ্বারা বাস্তবে সর্বত্রই সঠিকভাবে পথ চলা মোটেই সম্ভব নয়। তাছাড়া কোনটি ন্যায় কোনটি অন্যায় তার প্রভেদ সৃষ্টি করাও মানুষের পক্ষে সম্ভব হতো না। যদি মহান আল্লাহ ন্যায়-অন্যায় প্রভেদকারী মহাপ্রজ্ঞাদীপ্ত এই আল-কুরআন (ফুরকান) নাজিল না করতেন। আল কুরআন নাজিল করেছেন, জীবনে তার বাস্তব প্রয়োগ শিক্ষা দেবার জন্য হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে পাঠিয়েছেন রাসূল বানিয়ে। তিনি আজীবন আল কুরআনের পূর্ণ বাস্তবায়ন দেখিয়ে যাবার পরও আজ সমগ্র পৃথিবী জুড়ে চলছে চরম অন্যায়-অত্যাচার, জোর-জুলুম, ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম। মানুষ চরমভাবে পথভ্রষ্ট পশু যা করতে প্রবৃত্ত হয় না সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ সে নোংরা কাজটি অনায়াসে করছে। আল্লাহ সুবহানু ওয়া তায়ালা আল কুরআন আর মহানবী (সা.)-কে যদি না পাঠাতেন তবে পৃথিবীতে মানুষ একটি মুহূর্তও শান্তিতে আর স্বস্তিতে বসবাস করতে পারত না। অপরাধ করতে করতে অধঃপতনের শেষ সীমায় পৌছে যেত মানবতা, মনুষত্বের সামান্যতম কিছুও অবশিষ্ট থাকত না। গুমরাহীর অতল গহবরে ডুবে যাওয়ার কারণে দুনিয়ার জীবনে চরম অশান্তির দাবদাহে ভস্মীভূত হতো আর আখিরাতে হতো জাহান্নামের চিরস্থায়ী অধিবাসী।
জান্নাতে যাবার মতো একজন মানুষ খুঁজে পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়ত।
মহান আল্লাহ রামাদান মাসে আল কুরআন নাজিল করে পথের দিশা দিয়ে মানবজাতিকে যে প্রভুত কল্যাণ সাধন করেছেন তারই শুকুর-গুজারার্থে রমাদানের এক মাস আল্লাহ তায়ালা রোজা ফরজ করেছেন। তাছাড়া আল কুরআন থেকে তারাই হেদায়াত লাভ করে যারা আল্লাহকে ভয় করে চলে। অর্থাৎ যারা মুত্তাকি। রামাদানের রোজা মানুষকে মুক্তাকি বানাবার প্রশিক্ষণ। যাতে তারা জীবনের সর্বক্ষেত্রে কুরআন মেনে চলতে অভ্যস্থ হয় ।
আল্লাহ বলেন, জালিকাল কিতাবু লা রইবা ফিহে হুদাল্লিল মুত্তাকীন। (বাকারা-২-৩) ঐ কিতাবের (কুরআনের) মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই এটা আল্লাহ ভীরুদের জন্য হিদায়াত-পথনির্দেশ। আল কুরআন বান্দার জন্য আল্লাহর তরফ থেকে পথনির্দেশনা বা জীবন বিধান। যারা আল্লাহকেই পরোয়া করে না তারা তার দিকনির্দেশনা মানতে যাবে কেন! ফলে আল কুরআন থেকে কোনো হিদায়াতই তারা লাভ করতে পারে না।
আল্লাহ সুবহানু ওয়া তায়ালা সূরাতুল বাকারার ১৮৫ আয়াতে রোজা ফরজ করার উদ্দেশ্য-লক্ষ্য বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ বলেন,
‘হে মুমীনগণ! তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হলো, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে করে তোমরা মুত্তাকী হতে পার’। বুঝা গেল রোজা সব যুগের মানুষের জন্যই অতি প্রয়োজনীয় ইবাদত। কারণ মুত্তাকী না হলে অর্থাৎ আল্লাহ ভীতি ছাড়া ভালো মানুষ হওয়া যায় না। আর ভালো মানুষ ছাড়া একটি কল্যাণময় সুন্দর পৃথিবী কল্পনাও করা যায় না।
রামাদান মাসে অতি হিকমতপূর্ণ মহাপবিত্র আল কুরআন নাজিল হবার কারণেই এই মাস মহান আল্লাহর অশেষ করুণা ও নিয়ামতে পরিপূর্ণ। বিপুল মর্যাদার অধিকারী।
রামাদান মাসে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ক্ষমা ও নিয়াতম সম্পর্কে কিছু বিষয় নিম্নে তুলে ধরা হলো। যাতে রোজা পালনে আল্লাহর বান্দারা উৎসাহিত হতে পারেন।
* রামাদান শুরু হবার আগের রাতেই শয়তানদের শিকল দ্বারা বেঁধে ফেলা হয়। যাতে রোজাদার বান্দাদের অসঅসা বা কুমন্ত্রনা দিয়ে তারা কোনোরূপ ক্ষতি করতে না পারে।
* আকাশের দরজা খুলে দেয়া হয়। অর্থাৎ আল্লাহর রহমতের ভাণ্ডার খুলে দেয়া হয়। রোজাদার বান্দারা যে যত পারে রহমত লুপে নিতে পারে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই।
# এ মাসকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়।
* প্রথম দশদিন রহমতের
* দ্বিতীয় দশদিন মাগফিরাতের
* শেষের দশ বা নয়দিন নাজাতের
বান্দা প্রথম দশদিনে রোজা পালন ও বিভিন্ন ইবাদত করে আল্লাহর রহমত লাভ করে মাগফিরাত পাবার উপযোগী হয়। মাগফিরাতের দশদিন ইবাদত করে নাজাত লাভের উপযোগী হয়। আর শেষের দিনগুলোতে তাওবা-ইস্তিগফার ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে নাজাত লাভ করে ধন্য হয়।
* এ মাসে জান্নাতের দরজা খোলা রাখা হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়।
* এ মাসে কবরের আজাব বন্ধ থাকে।
* প্রতিদিন কিছু বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
* এ মাসে একটি ফরজ কাজ অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ কাজের সমান। একটি নফল কাজ অন্য মাসের একটি ফরজ কাজের সমান। একটি ফরজের মর্তবা- গুরুত্ব এমন যে মানবসৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সকল মানুষের সকল নফল ইবাদত একটি ফরজ কাজের সমান নয়।
* এ মাসে সাধারণভাবে একটি নেক কাজের বদলা আল্লাহ সুবহানু ওয়া তায়ালা দশ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত দিয়ে থাকেন।
* হাদিসে এসেছে যে ব্যক্তি ঈমানের মজবুতী আর আত্মবিশ্লেষণের জন্য রোজা রাখে আল্লাহ সুবহান ওয়া তায়ালা তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন।
* এ মাসে একটি রোজা রাখলে ঐ রোজাদার আর জাহান্নামের মধ্যে আসমান এবং জমিনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়।
* ঈমানের মজবুতী এবং আত্মবিশ্লেষণের বা সওয়াবের জন্য যে ব্যক্তি এ মাসে রাতে দাঁড়িয়ে ইবাদত করে তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। (বুখারী-মুসলিম।)
* এ মাসে এমন একটি রাত আছে যার নাম ‘শব ই ক্বদর বা লায়লতুল ক্বদর । এ রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত থেকে শ্রেয়। অর্থাৎ ত্রিশ হাজার রাতের ইবাদত থেকে উত্তম।
কুরআনে বলা হয়েছে- ‘লাইলাতুল ক্বদরে খাইরুম মিন আলফি শাহর্।’ কদরের রাত সহস্র মাসের ইবাদতের থেকেও শ্রেয়। আল-কদর-৩।
* হাদিসে এসেছে ঈমানের মজবুতী আর আত্মবিশ্লেষণের জন্য শবই কদরের রাতে দাঁড়িয়ে ইবাদত করে মহান আল্লাহ তাদের পূর্বের যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দেন। সহীহ বুখারী-মুসলিম।
হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমার উম্মতকে রমাদান মাসে পাঁচটি বৈশিষ্ট্য দান করা হয়েছে।
১. রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের সুগন্ধি হতেও বেশি উত্তম।
২. রোজাদারগণ যতক্ষণ ইফতার না করে ফেরেশতাগণ তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে।
৩. আল্লাহ তায়ালা তাদের উপলক্ষে প্রতিদিন জাহান্নাতকে সুসজ্জিত করে রাখেন। আর জান্নাতকে লক্ষ্য করে বলেন, আমার নেক বান্দাদের সব বৈষয়িক কষ্ট শ্রম ক্লেশ ও পীড়ন দূর হয়ে গেলে তারা এই জান্নাতে এসে প্রবেশ করবে। দুনিয়ার জীবন শেষ হবার পর এই জান্নাতই তাদের শেষ পরিণতি, শেষ আশ্রয়স্থল।
৪. শয়তানদের মধ্যে যারা প্রধান দুষ্কৃতিকারী তাদেরকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। যাতে তারা রোজাদারদের কোনো ক্ষতি করতে না পারে।
৫. নেক বান্দাদের জন্য শেষ রাতে মাগাফিরাত দান করা হয়। প্রশ্ন করা হলো ইয়া রসূলুল্লাহ! এটা কি কদর রাতের কথা? তিনি বললেন, না, কিন্তু আমলকারী যখন তার আমল সম্পন্ন করবে তখন তার প্রতিফল পুরোপুরি আদায় করা হবে।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় – যে কুরআন নাজিলের শুকরিয়া আদায়ের জন্য রোজা ফরজ করা হলো, রমাদানের এতো বরকত ও মর্যাদা দান করা হলো- সে রোজা নিয়ে মুসলমানরা যত গুরত্ব বা ব্যস্ততা দেখায়, কুরআন জানা বুঝা ও জীবনে সর্বক্ষেত্রে মেনে চলার, সমাজে প্রয়োগের ব্যপারে শতভাগের একভাগ প্রচেষ্টা তাদের নেই । যে কারণে আজ সর্বত্রই নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত। আল্লাহ আমাদের এ সত্য উপলব্দি ও সংকট উত্তরণের তৌফিক দান করুন – আমীন !!!
প্রভাষক,
রাজাপালং ফাযিল ডিগ্রী মাদরাসা, উখিয়া
খতীব,
আলিফ-লাম-মীম জামে মসজিদ
লাবণী বীচ পয়েন্ট, ককস বাজার ।
পাঠকের মতামত